একদিকে ব্যবসায় জগতে ব্যাপক উন্নয়ন অন্যদিকে একমালিকানা ও অংশীদারি ব্যবসায়ের সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতার কারণে নতুন সংগঠন কাঠামো কোম্পানি সংগঠনের উৎপত্তি ঘটে, পরবর্তী সময়ে ব্যবসায় জগতে আরো ব্যাপক উন্নয়নের ফলে এর ব্যবসায়ের গতি প্রকৃতিতেও পরিবর্তন সূচিত হয়। যার ফলে কোম্পানির ধরনেও পার্থক্য ঘটে । নিম্নে কোম্পানির প্রকারভেদ বিস্তারিত আলোচিত হলো—
সদস্যদের দায়ের প্রকৃতি অনুসারে এরূপ শ্রেণীবিন্যাস করা হয়। দায়-এর প্রকৃতি অনুযায়ী কোম্পানি তিন প্রকার হতে পারে। যথা—
১. শেয়ার দ্বারা সীমাবদ্ধ দায়বিশিষ্ট কোম্পানি (Companies limited by share): যে কোম্পানিতে সদস্যগণের দায় শেয়ারের আংকিক মূল্য পর্যন্ত সীমিত থাকে, তাকে শেয়ার দ্বারা সীমাবদ্ধ দায়বিশিষ্ট কোম্পানি বলে । যেমন-প্রাইভেট লিমিটেড ও পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি।
২. প্রতিশ্রুতি দ্বারা সীমাবদ্ধ দায়সম্পন্ন কোম্পানি (Companies limited by guarantee): যেসব কোম্পানিতে সদস্যগণ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পর্যন্ত দায় পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়, তাদের প্রতিশ্রুতি দ্বারা সীমাবদ্ধ দায়সম্পন্ন কোম্পানি বলে। এরূপ কোম্পানিতে যে সব সদস্য শেয়ার দ্বারা প্রতিশ্রুতি দায় বহন করে, শেয়ারের অপরিশোধিত মূল্য পর্যন্ত তাদের দায় থাকে। শেয়ারমূল্য পরিশোধিত হয়ে গেলে তারা দায়মুক্ত। আর্থিক মূল্য দ্বারা প্রতিশ্রুতি দায়সম্পন্ন সদস্যগণ ঐ পরিমাণ অর্থ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত দায়বদ্ধ থাকেন। সাধারণত অব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এ ধরনের প্রতিশ্রুত কোম্পানি গঠিত হয় ।
যেসব কোম্পানিতে সদস্যগণের দায় অসীম হয়, তাদের অসীম দায়সম্পন্ন কোম্পানি বলে। এসব কোম্পানিতে সৃষ্ট দায়ের জন্য কোম্পানির সম্পত্তি ছাড়াও শেয়ারহোল্ডারগণের ব্যক্তিগত সম্পত্তি দায়বদ্ধ হয়। বর্তমানে এ ধরনের কোম্পানি নেই বললেই চলে ।
গঠন প্রকৃতির উপর নির্ভর করে কোম্পানিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়—
১. সনদপ্রাপ্ত কোম্পানি (Chartered company): রাষ্ট্রপ্রধান বা রাজা বা রানীর বিশেষ আদেশ বলে এ ধরনের কোম্পানি গঠিত হয়। বিশেষ করে কোম্পানি আইন চালু হওয়ার পূর্বে এ ধরনের কোম্পানি গঠিত হতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, দি ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, দি চার্টার্ড ব্যাংক অব অস্ট্রেলিয়া- এ ধরনের কোম্পানির উদাহরণ। বর্তমানে এখন আর এরূপ কোম্পানি সংগঠন দৃষ্টিগোচর হয় না ।
২. বিধিবদ্ধ কোম্পানি (Statutory company) :
যখন দেশের আইন পরিষদ বা পার্লামেন্টে বিশেষ আইনের মাধ্যমে কোনো কোম্পানি গঠিত হয়, তখন তাকে বিধিবদ্ধ কোম্পানি বলে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া প্রভৃতি এরূপ কোম্পানি ।
৩. নিবন্ধিত কোম্পানি (Registered company) : যেসব কোম্পানি নিবন্ধকের অফিসে তালিকভুক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়, সেগুলোকে নিবন্ধিত কোম্পানি বলে। বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ কোম্পানিই নিবন্ধিত কোম্পানি ।
সদস্য সংখ্যার উপর ভিত্তি করে কোম্পানিকে প্রধানত দুভাগে ভাগ করা হয়—
১. প্রাইভেট লিঃ কোম্পানি (Private ltd. company): আধুনিক বৃহদায়তন ব্যবসায় জগতে স্বাধীন সত্তা ও সীমিত দায় বিশিষ্ট ছোট ধরনের কোম্পানি সংগঠন হল প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। এটি নিজ নামেই সর্বসাধারণ্যে পরিচিত। সাধারণত আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব মিলে সীমিত দায়ের ভিত্তিতে যে কোম্পানি গঠিত ও পরিচালিত হয় তাকে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বলে ।
বস্তুত যে কোম্পানির সদস্য সংখ্যা সর্বনিম্ন দু'জন এবং সর্বোচ্চ পঞ্চাশ জনে সীমাবদ্ধ এবং যার শেয়ার অবাধে হস্তান্তরযোগ্য নয়, তাকে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বলে ।
১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ২(১) (ট) ধারায় বলা হয়েছে যে,“প্রাইভেট লিমিটেড” বলতে এমন কোম্পানিকে বুঝাবে যা এর পরিমেল নিয়মাবলি দ্বারা—
ক. কোম্পানির শেয়ার যদি থাকে, হস্তান্তরের অধিকারে বাধানিষেধ আরোপ করে ।
খ. কোম্পানির শেয়ারে বা ডিবেঞ্চারে (যদি থাকে) চাঁদা দানের নিমিত্ত (Subscription) জনসাধারণের প্রতি আমন্ত্রণ জানানো নিষিদ্ধ করে।
গ. এর সদস্য সংখ্যা কোম্পানির চাকরিতে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ ব্যতীত পঞ্চাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। সদস্য সংখ্যা সীমিত বলে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্রায়তনের হয়ে থাকে। কোম্পানি আইন অনুযায়ী এই কোম্পানির গঠন থেকে শুরু করে পরিচালনার বিভিন্ন স্তরে আইনগত ঝামেলা অনেকটা কম । আইন অনুযায়ী এটা স্বাধীন কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তার মর্যাদা ভোগ করে এবং শেয়ারহোল্ডারদেও দায় সীমাবদ্ধ থাকে ।
সুতরাং, প্রচলিত কোম্পানি আইনের অধীনে নিবন্ধিত হয়ে যে কোম্পানি কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তার মর্যাদা লাভ করলেও পরিমেল নিয়মাবলি অনুযায়ী ৫০ জনের অধিক সদস্য গ্রহণ করতে পারে না, জনসাধারণের উদ্দেশ্যে শেয়ার বিক্রয়ের আহবান জানাতে পারে না এবং শেয়ার মালিকগণ অবাধে শেয়ার হস্তান্তরের সুবিধা ভোগ করে না তাকে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বলে ।
২. পাবলিক লিঃ কোম্পানি (Public ltd. company): মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে কমপক্ষে ৭ (সাত) জন এবং সর্বোচ্চ যেকোন সংখ্যক (শেয়ার সংখ্যা দ্বারা সীমাবদ্ধ) সদস্য স্বেচ্ছায় সীমিত দায়ের ভিত্তিতে শেয়ার হস্তান্তরের অধিকার নিয়ে কৃত্রিম সত্তাবিশিষ্ট যে প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়, তাকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি বলে। এই সংগঠনের মূলধন কতকগুলো খন্ড খন্ড শেয়ারে বিভক্ত এবং শেয়ারগুলো অবাধে হস্তান্তরযোগ্য। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ আলাদা। কোম্পানির নির্বাচিত পরিচালক পর্ষদ দ্বারা এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা কার্য পরিচালিত হয়। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি নিবন্ধিত হবার পর কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র সংগ্রহ করে তার কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে শুরু করে। বাংলাদেশের পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির আইনগত সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো:
১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ২(১-ঞ) ধারায় বলা হয়েছে যে, “পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি বলতে প্রাইভেট কোম্পানি নয় এমন কোম্পানি বোঝায়, যা কোম্পানি আইন ১৯৯৪ সাল বা কোম্পানি আইন ১৯১৩ বা ১৮৮২ অথবা কোম্পানি আইন ১৮৮৬ অথবা এতদ্বারা বাতিলকৃত অন্য কোন আইন অনুযায়ী নিবন্ধিত হয়েছে।”
পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি সর্বাপেক্ষা বেশি জনপ্রিয়। মুনাফা অর্জনের নিমিত্তে বহু সংখ্যক ব্যক্তির ক্রীত শেয়ারের ভিত্তিতে কোম্পানি আইন অনুযায়ী এই কোম্পানি গঠিত ও পরিচালিত হয়।
মালিকানার ভিত্তিতে কোম্পানি দু'রকম হতে পারে। যেমন—
১. সরকারি কোম্পানি (Government company): যেসব কোম্পানি সাধারণত সরকারি মালিকানায় গঠিত হয়, অথবা কোম্পানিতে কমপক্ষে ৫১% শেয়ারের মালিকানা সরকারের থাকে তাকে সরকারি কোম্পানি বলে ।
২. বেসরকারি কোম্পানি (Non-government company): যেসবকোম্পানি বেসরকারি মালিকানায় পরিচালিত হয় সেগুলোকে বেসরকারি কোম্পানি বলে ।
১. হোল্ডিং কোম্পানি (Holding Company): কোন কোম্পানি গঠন বা ক্রয়সূত্রে অন্য কোম্পানি নিয়ন্ত্রণের অধিকাংশ ক্ষমতা পেলে তাকে হোল্ডিং কোম্পানি বা নিয়ন্ত্রণকারী কোম্পানি বলে। এরূপ কোম্পানি নিয়ন্ত্রণকৃত কোম্পানির ৫০%-এর অধিক শেয়ারের মালিক এবং অধিকাংশ পরিচালক নিয়োগ ও অপসারণ ক্ষমতা ভোগ করে।
হোল্ডিং কোম্পানির বৈশিষ্ট্য হলো—
ক. কোন কোম্পানির শেয়ার মূলধনের ৫০% এর বেশি সরবরাহকারী;
খ. সাবসিডিয়ারি কোম্পানির অধিকাংশ পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা এ কোম্পানির উপর ন্যস্ত থাকে;
গ. অধীনস্থ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিষদ নির্বাচনের দায়িত্বও এ কোম্পানি বেশিরভাগই ভোগ করে;
ঘ. পরিচালকদের পদচ্যুতি বা অবসরদানের ক্ষমতাও এর উপর ন্যস্ত থাকে;
ঙ. এ কোম্পানির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থেকে অধীনস্থ কোম্পানিটি পরিচালিত হয়; ইত্যাদি।
২. সাবসিডিয়ারি কোম্পানি (Subsidiary company): যেসব কোম্পানির ৫০% -এর অধিক শেয়ারের মালিক অন্য কোম্পানি তাকে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বলে। অর্ধেকের বেশি মূলধন সরবরাহকারী কোম্পানি এরূপ কোম্পানির পুরো নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকে। নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিকে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বলা হয় ।
৩. বিদেশি কোম্পানি (Foreign company): যে কোম্পানি দেশের বাইরে গঠিত হয়ে, কোনো নির্দিষ্ট দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করে, তাকে বিদেশি কোম্পানি বলে ।
৪. বহুজাতিক কোম্পানি (Multinational company):
যে কোম্পানির মালিকানা, ব্যবস্থাপনা এবং নিয়ন্ত্রণে একাধিক দেশের অধিবাসী অন্তর্ভুক্ত থাকে তাকে বহুজাতিক কোম্পানি বলে। যেমন—ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড, নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেড ইত্যাদি। পরিশেষে বলা যায় যে, কোম্পানি সংগঠন বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। ব্যবহারের বৈচিত্র্য, উদ্দেশ্যের ভিন্নতা কিংবা সময়ের ভিত্তিতে কোম্পানির বিচিত্রতা প্রসারিত হয়েছে।